বাংলাদেশের যৌনব্যবসা ও যৌনকর্মীরা

৪:২১ PM
যৌনকর্মী ও যৌনব্যবসা কী?
যৌন ব্যবসা যদিও পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশার একটি, যৌনকর্মী শব্দ প্রথম ব্যবহার করেন যৌনকর্মী, লেখক, নির্মাতা ও যৌনকর্মী অধিকারবাদী ক্যারল লেই। তিনি তার ওয়ানউওম্যানশো নাটকে এই শব্দের প্রয়োগ দেখান ১৯৭৮ সালে।
যৌনকর্মী শব্দের উৎস নিয়ে ক্যারল লেই এর লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত সম্পাদিত প্রবন্ধ সংকলনে। ।।
এর পর থেকেই মূলত রিসার্চ, এনজিও ও মানবাধিকার সংগঠনে এই শব্দের বহুল ব্যবহার চালু হয়। মূলত যৌনকর্মী এবং তাদের অধিকার আদায়ে সচেতন ব্যক্তি ও গোষ্ঠির আন্তরিকতায় পেশা হিসেবে সম্মান জানানোর লক্ষ্যে এই শব্দ বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয়।
২০০০ সালে প্রকাশিত ইউকে হোম অফিসের এক রিসার্চে . বলা হয় যৌনকর্মী শব্দটি পতিতাবৃত্তির মতো জটিল, বিতর্কিত ও লৈঙ্গিক বৈষম্য থেকে মুক্ত।
২০০৬ এ এক ইউএস মেডিক্যাল জার্নালে  প্রকাশিত এক প্রবন্ধে অর্থ, বস্তু ও অন্যান্য লাভের জন্য যৌন সেবা প্রদান ও গ্রহণ করার পারষ্পরিক বিনিময়কে যৌন ব্যবসা বলা হয়।
২০০৯ এ প্রকাশিত UNAID guidance note on HIV/AIDS  এ বলা হয় পূর্ণবয়স্ক পুরুষ, নারী, ট্রানজেন্ডার ও ১৮-২৪ বছর বয়েস পর্যন্ত যেকোন লিঙ্গের তরুন নিয়মিত অথবা অনিয়মিতভাবে অর্থ কিংবা অন্য কোন বস্তুর বিনিময়ে যৌন সেবা প্রদান করলে তাকে যৌনকর্মী বলা হবে। এই পেপারে অনানুষ্ঠানিক (Less formal) ও সংগঠিত/প্রাতিষ্ঠানিক (Organised) দুই ধরনের যৌনব্যবসার সাথে জড়িত কর্মীদের যৌনকর্মীর আওতায় আনা হয়।
২০০৫ এ ইউকে থেকে প্রকাশিত গবেষণামূলক এই বইয়ে  লেখকদ্বয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত যৌন ব্যবসার একটি লম্বা তালিকা প্রস্তুত করেন। এই তালিকা থেকে তারা যৌন ব্যবসাকে ভাগ করেন দুই ভাগেঃ
ক) প্রত্যোক্ষ (direct) যার মধ্যে আছে গৃহমধ্যস্ত (indoor: ব্রোথেল, হোটেল, আবাসিক, এস্কর্ট) ও বহিরাঙ্গন (outdoor: স্ট্রিটবেইজড) এই দুই ধরণের কার্যক্রম। এই ব্যবসায় সাধারণত ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে সম্মানীর বিনিময়ে যৌন মিলন সংগঠিত হয়।
খ) পরোক্ষ (indirect) এর মধ্যে আছে সাধারণত যৌন মিলন বিহীন কার্যক্রম যেমন পোল ডান্স, স্ট্রিপিং, ফোন ও ইন্টারনেট সেক্স। যৌন মিলন না হলেও এই ব্যবসাও সম্মানী ও মুনাফা নির্ভর।
এই প্রচলিত ও গ্রহনীয় সংজ্ঞা মেনে নিয়ে বলা যায় কোন ব্যাক্তি - পুরুষ এবং নারী যেকোন রকম সম্মানীর বিনিময়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যৌনসেবা প্রদান করলে এই বিনিময় যৌন ব্যবসা এবং সেবা প্রদানকারীকে যৌনকর্মী বলা হয়।
এর বিপক্ষেও কিছু মত আছে। আপাতত সেই ব্যাখায় যাচ্ছিনা।
এই লেখায় শুধুমাত্র যৌনপল্লীর প্রেক্ষাপট এবং সেখানে কর্মরত যৌনকর্মীদের কথা আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে কি যৌনব্যবসা বৈধ?
২০০০ সালে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী বাংলাদেশে যৌনব্যবসা আইনত বৈধ। 
কিন্তু বাংলাদেশের আইন ও সংবিধান এই ক্ষেত্রে বিরোধী অবস্থানে আছে।
ক) সংবিধানের ১৮(২)অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে “রাষ্ট্র জুয়া এবং যৌনব্যবসার বিরুদ্ধে কার্যকরী সুরক্ষা প্রদান করিবে” (The State shall adopt effective measures to prevent prostitution and gambling.) 
খ) Suppression of Immoral Traffic Act, 1933 - prohibits prostitution of underage girls (girls under the age of 18) and brothel keeping. It is also an offence for third parties to import, export, sell, or hire a woman for prostitution under Oppression of Women and Children (Special Enactment) Act, 1995. Section 290 of the Penal Code of 1860 categorises prostitution under public nuisance and Section 74 of DMP Ordinance, 1976 defines it in the frames of public nuisance as an attempt to attract attention, solicit, or molest in a public place for the purposes of prostitution. [/i] 
গ) মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ অনুসারে (দেশের ভেতরে ও বাইরে) ১০ ১১‘‘পতিতাবৃত্তি’’ অর্থ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অথবা অর্থ বা সুবিধা (kind) লেনদেন করিয়া কোন ব্যক্তির যৌন শোষণ বা নিপীড়ন;
(৯) ‘‘পতিতালয়’’ অর্থ পতিতাবৃত্তি পরিচালনার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত কোন বাড়ি, স্থান বা স্থাপনা; মানব পাচারের মধ্যে
‘‘শিশু’’ অর্থ আঠার বৎসর বয়স পূর্ণ করে নাই এমন কোন ব্যক্তি;
[/i](নিষিদ্ধ)
ঘ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুসারে ১২
৫৷ (১) যদি কোন ব্যক্তি পতিতাবৃত্তি বা বেআইনী বা নীতিবিগর্হিত কোন কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে কোন নারীকে বিদেশ হইতে আনয়ন করেন বা বিদেশে পাচার বা প্রেরণ করেন অথবা ক্রয় বা বিক্রয় করেন বা কোন নারীকে ভাড়ায় বা অন্য কোনভাবে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে হস্তান্তর করেন, বা অনুরূপ কোন উদ্দেশ্যে কোন নারীকে তাহার দখলে, জিম্মায় বা হেফাজতে রাখেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অনধিক বিশ বত্সর কিন্তু অন্যুন দশ বত্সর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷
(২) যদি কোন নারীকে কোন পতিতার নিকট বা পতিতালয়ের রক্ষণাবেক্ষণকারী বা ব্যবস্থাপকের নিকট বিক্রয়, ভাড়া বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করা হয়, তাহা হইলে যে ব্যক্তি উক্ত নারীকে অনুরূপভাবে হস্তান্তর করিয়াছেন তিনি, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, উক্ত নারীকে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে বিক্রয় বা হস্তান্তর করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং তিনি উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন৷
(৩) যদি কোন পতিতালয়ের রক্ষণাবেক্ষণকারী বা পতিতালয়ের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কোন ব্যক্তি কোন নারীকে ক্রয় বা ভাড়া করেন বা অন্য কোনভাবে কোন নারীকে দখলে নেন বা জিম্মায় রাখেন, তাহা হইলে তিনি, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, উক্ত নারীকে পতিতা হিসাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে ক্রয় বা ভাড়া করিয়াছেন বা দখলে বা জিম্মায় রাখিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন৷
হাইকোর্টের রায়
২০০০ সালে টানবাজার-নিমতলী যৌনপল্লী উচ্ছেদের প্রতিবাদে বাংলাদেশ সোসাইটি ফর এনফোর্সমেন্ট অফ হিউম্যান রাইটস(BSEHR) ও অন্যান্য এনজিও হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করে।
পিটিশনের কারণ হিসেবে পুলিশ ও প্রশাসন কতৃক যৌনকর্মীদেরদের অবৈধভাবে, জোরপূর্বক তাদের বাসস্থান থেকে উৎখাত করা এবং এর প্রেক্ষিতে যৌনবৃত্তিতে নিযুক্ত নারীদের নাগরিক হিসেবে সমান সুযোগ প্রদান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়।
আবেদনকারীরা বর্ণনা করেন ২৪শে জুলাই ১৯৯৯ ভোর রাতে যখন নিমতলী, টানবাজার ও নারায়ণগঞ্জ পল্লীর বাসিন্দারা ঘুমিয়ে ছিলেন তখন পুলিশ জোরপূর্বক তাদের ঘরে প্রবেশ করে কোনভাবে গুছাবার কিংবা তৈরী হবার সুযোগ না দিয়ে শিশুসহ যৌনকর্মীদের শারীরিকভাবে আঘাত করে বাইরে অপেক্ষমান বাসে তুলে দেয় এবং ভবঘুরে আইন ১৯৫০ অনুসারে তাদের কাশিমপুর ভবঘুরে কেন্দ্রে স্থানান্তর করে।
বিবাদীপক্ষ সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয় এই পুরো পদ্ধতিতে কোথাও কোন আইন ভঙ্গ হয়নি এবং আইনের নিয়ম মেনেই তাদের ভবঘুরে কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
আদালত বিস্তৃত ব্যাখ্যায় বলেন যৌনপল্লীতে থাকা নারীরা সমাজের সবচেয়ে কম সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনার ফলাফল হিসেবে তারা এই পেশায় জড়িত আছেন। পুলিশ ও স্থানীয় দ্বারা যৌনকর্মীদের তাদের আবাস থেকে উৎখাত সংবিধান পরিপন্থী ও অবৈধ। আদালত টানবাজার ও নিমতলী যৌনপল্লীর বাসিন্দাদের ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া ও আটকে রাখাকেও অবৈধ ঘোষনা করেন।
এই ল্যান্ডমার্ক পিটিশনের রায়ে নারী যৌনকর্মী অনুর্ধ ১৮ বছরের হলে এবং যৌন ব্যবসাই তার আয়ের একমাত্র উৎস প্রমান করতে পারলে তিনি বৈধভাবে যৌনব্যবসায় অংশগ্রহন করতে পারেন। ১৩
যৌনকর্মী নোটারি পাবলিকের সাহায্যে প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এফিডেবিট দিয়ে বৈধ ভাবে কাজ করার জন্য নিবন্ধিত হন। হলফনামা কিংবা এফিডেবিটে তিনি ঘোষনা করেন তার বয়স অনুর্দ্ধ আঠারো এবং জীবনধারনের কোন উপায় না থাকায় কোন মহলের বলপ্রয়োগ ছাড়া স্বেচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছেন।
উল্লেখ্য বাংলাদেশের আইনে পুরুষ এবং ছেলে-মেয়ে উভয় শিশুর যৌনব্যবসা নিষিদ্ধ।

Share this

Related Posts

Previous
Next Post »